নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রেমন ইবনে ইসলাম
ফেডারেশন কাপের শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনাল ম্যাচে ৩০ মে মঙ্গলবার চোখে চোখ রেখে লড়াই করে দেশের ঐতিহ্যবাহী দুই ক্লাব আবাহনী-মোহামেডান। এ লড়াই যেন মনে করিয়ে দেয় সেই ৯০ এর দশকের মোহামেডান ও আবহনীর লড়াইকে।
এই যেমন ১৯৮৭ সালে আবাহনী-মোহামেডানের খেলাকে ঘিরে সমর্থকদের সম্ভাব্য সংঘর্ষ ও রক্তপাতের আশঙ্কায় দর্শকশূন্য আর্মি স্টেডিয়ামে খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কতটা উত্তেজনা বিরাজমান থাকলে খেলার মাঠ ছাপিয়ে মাঠের বাইরে এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে! ঢাকার ফুটবলের ঐতিহ্যের ঐ বিষয়টি এখনো কোনভাবেই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
কারো কারো কাছে আবার এটির নাম ’ঢাকা ডার্বি’। উঁচুতে চোঁখ রাখা মানুষগুলো এতে আপত্তি জানালেও ফুটবলের কথা ভাবলে মেনে নিতেই হবে। হয়তো ইউরোপের ফুটবলের মতো রাত জেগে আর দেশের ফুটবলের কথা কেউ ভাবেন না। অথচ ভাবুন তো, নব্বই দশকেও রাজধানী ঢাকা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত এই দুই দলের লড়াইয়ের আগে। মাঠের লড়াই চলে যেত, পাড়া মহল্লায়, অফিস, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আকাশী-নীল জার্সির ধারক আর বাহক আবাহনী খেলতো ছোট ছোট পাসে, যা অনেকটা বর্তমানের বার্সেলোনার মতো। অন্যদিকে সাদা-কালো মোহামেডান ঠিক তার উল্টো ষ্টাইলে খেলাটা। রিয়াল মাদ্রিদের মতো লং পাস করে পাওয়ার ফুটবলের সেরা ছিল তারা। অনেকের কাছে আবাহনী-মোহামেডান লড়াইটা বাংলাদেশের এল ক্লাসিকো!
২০০৯ সালে কোটি টাকা প্রাইজমানির প্রথম সুপার কাপের শিরোপা জিতিয়ে দলের আনন্দ উৎযাপনের সঙ্গী হয়েছিলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেড। ২০০৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বিডিআর বিদ্রোহের পর মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত ফাইনাল নিয়ে নিরাপত্তায় ছিল বেশ কড়াকড়ি। তবুও দর্শকদের মধ্যে আগ্রহের কোন কমতি ছিলনা। ফাইনাল ম্যাচে মাঠে যত দর্শক উপস্থিত হয়েছিল তার চেয়েও বেশি দর্শক ষ্টেডিয়ামের বাইরে অবস্থান করছিল। আমার স্বরণশক্তি বলছে, দেশের ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডান সর্বশেষ দর্শকে পরিপূর্ণ খেলা ছিল এটি। এরপর বহুবার চিরপ্রতিদ্বন্ধী এই দল দুটি মাঠে নামলেও এতটা দর্শকের দেখা মেলেনি।
গতকাল ফেডারেশন কাপের শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে টাইব্রেকারে আবাহনী লিমিটেডকে হারিয়ে ১৪ বছর পর চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে বিকেল সোয়া ৩টায় শুরু হয়, স্টেডিয়াম ছিল কাণায় কাণায় পূর্ন, ম্যাচে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে দেশের ঐতিহ্যবাহী দুই ক্লাব আবাহনী-মোহামেডান এবং নির্ধারিত ৯০ মিনিটে খেলা ৩-৩ ড্র হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত (৩০ মিনিট) সময়ে। অতিরিক্ত সময়েও খেলা ৪-৪ ড্র হয়। যে কারণে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। পেনাল্টি শুটআউটে আবাহনীকে ৪-২ ব্যবধানে হারিয়ে ১৪ বছর পর শিরোপার উল্লাসে মেতে ওঠে মতিঝিলের ক্লাব মোহামেডান। ঠিক ২০২২ বিশ্বকাপে ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা ম্যাচের মধ্যে যে ভাবে ক্ষণে ক্ষণে রং বদলিয়েছে, খেলার ফলাফল পরিবর্তন হয়েছে ঠিক তেমনি গত কালকের ম্যাচেও তার প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়।
ম্যাচের ১৫ মিনিটে ফয়সাল আহমেদ ফাহিমের গোলে এগিয়ে যায় আবাহনী। খেলার ৪৩তম মিনিটে কোস্টারিকার ড্যানিয়েল কলিন্দ্রেসের গোলে ব্যবধান দ্বিগুণ করে আবহনী। ম্যাচের দৃশ্যপট পাল্টে যায় দ্বিতীয়ার্ধে, ৫৫ মিনিটে ও ৫৯ মিনিটে সোমালিয়ার খেলোয়ার সলেমান দিয়াবাতে গোল করে খেলায় সমতা ফেরান, মোহামেডান সমতা আনার মিনিট পাঁচেক ৬৫ মিনিটে নাইজেরিয়ান এমেকার গোলে আবাহনী ফের (৩-২) ব্যবধানে এগিয়ে যায়। ৮৩ মিনিটে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন মোহামেডানের অধিনায়ক সোলেমান দিয়াবাত। তার কল্যাণে মোহামেডান আবারো (৩-৩) সমতায় ফেরে। খেলার ১০৫ মিনিটে সোলেমান দিয়াবাতে গোলের জন্য এগিয়ে যান, আবাহনীর গোলরক্ষক গোল ঠেকাতে পা বাড়িয়ে দেন গোলরক্ষক সোহেল। রেফরি পেনাল্টির বাঁশি বাজান। পেনাল্টি শটে মোহামেডানের অধিনায়ক সোলেমান দিয়াবাতে গোল করে দলকে ৪-৩ গোলে এগিয়ে নেন। সোলামান দিয়াবাতে একাই ৪টি গোল করেন, ঠিক যেন, ২০২২ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের এমবাপের পারফরমেন্স কে যেন মনে করিয়ে দেয়, অসাধারণ খেলেছেন এই সোমালিয়ান স্ট্রাইকার। মোহামেডানের নিয়মিত গোলরক্ষক সুজন হোসেন যিনি এই ম্যাচ ও অনেক গুলো সুন্দর সেভ করেন, তিনি ১১২ মিনিটে ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছাড়লে মোহামেডান শিবির চিন্তিত হয়ে পড়েন, তারপর পরই ১১৯ মিনিটে রহমতের দুর্দান্ত গোলে ফের সমতায় ফিরে আবাহনী। অতিরিক্ত সময়ে খেলা ড্র হওয়ায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। ঠিক পরিবর্তীত গোলরক্ষক আহসান হাবীব বিপুর যেন মোহামেডান এর ত্রাণ কর্তা রুপে আর্বিভূত হয়ে আবাহনীর দুই বিদেশি খেলোয়াড় রাফায়েল এবং দানিয়েল কলিঞ্জ গোল ঠেকিয়ে দিয়ে মতিঝিলের ঐতিহ্যবাহী দলকে জয়ের আনন্দে ভাসিয়ে দেন এবং মোহামেডান স্পোটিং ক্লাব ১৪ বছর পর শিরোপা ঘরে তোলেন।
ঢাকার ফুটবলে কাগুজে হলেও এখনো আবাহনী-মোহামেডান নাম দুটো বড় অর্থ বহন করে। ফুটবল বিশ্লেষকদের বেশিরভাগেরই ধারনা, দেশের ফুটবলের উন্নতি হওয়ার আগে প্রয়োজন এই দুই দলের উন্নতি। আবাহনীর তো আছে, এখন প্রয়োজন মোহামেডানের। এই দুই দলের মাঝে দেশের ফুটবলের বেশিরভাগ আসরের শিরোপা ভাগাভাগি হয়ে আছে। আবার সেই ধারা ফিরে আসলে বাংলাদেশের ফুটবলই এতে উপকৃত হবে।
এই খেলার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলে আবার সেই ৮০ ও ৯০ দশকের উত্তেজনা ফিরে আসুক সেই প্রত্যাশা ফুটবল বিশ্লেষকদের।