এ বছর একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন স্বদেশ সমাচার এর প্রধান সম্পাদক ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন ঘোষাল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মনোরঞ্জন ঘোষালসহ দেশের ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ২০২৩ সালের একুশে পদক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
তিনি বলেন, সারা জীবন দেশের জন্য গান গেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিয়েছি। দেশ-বিদেশের অনেক শিল্পীর সঙ্গে সময় কাটিয়েছি, গান করেছি। জীবনে খুব ভালো ভালো স্মৃতি রয়েছে। এখন দেহটা চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে দান করে দিচ্ছি। দু-এক দিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে দেহদানের কাজটি সম্পন্ন করব।
ছোটবেলায় মায়ের কাছেই সংগীতে হাতেখড়ি। তারপর ধীরে ধীরে শিল্পী হয়ে ওঠা। ছাত্র হিসেবেও তুখোড় ছিলেন তিনি। পড়েছেন জগন্নাথ কলেজে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে এম কম ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি আদর্শ মানেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।
মনোরঞ্জন ঘোষাল ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের দুঃশাসনবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সময় যোগ দিয়েছিলেন বিক্ষুব্ধ শিল্পীগোষ্ঠীতে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গুলিতে তার বড় ভাই রতন ঘোষাল শহীদ হন। ৩১ মার্চ সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তরুণ মনোরঞ্জন। তারপর ব্রাশফায়ারের ভেতরে ৩৩ জনের মধ্যে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মনোরঞ্জন। পরে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। পরবর্তী সময়ে মনোরঞ্জন ঘোষাল পরিচিতি পান স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে।
১৯৭১ সালে লাশের ভেতর থেকে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে নিজের শরীরে কয়েকবার চিমটি কেটে টের পেয়েছিলেন, তিনি বেঁচে আছেন। আজো যখন জগন্নাথ কলেজ, জজকোর্ট ভবনের সামনে দিয়ে যান, শিহরিত হন। বারবার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চের সেই রাত, যে রাতে অবিশ্বাস্যভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছিলেন তিনি। তার নিজের ভাষায়, ‘ছোটবেলায় একবার গ্রামে গিয়ে বাদুড়ের গায়ের গন্ধে শরীর গুলিয়ে উঠেছিল। একাত্তরের ৩১ মার্চের সেই রাতে যখন লাশের স্তূপের মাঝখান দিয়ে বের হয়েছিলাম, তখনো নাকে লাগে সেই বাদুড়ের গায়ের গন্ধ। এখনো বাদুড়ের গায়ের গন্ধ মাঝেমধ্যেই শরীর গুলিয়ে দেয়।’
মনোরঞ্জন ঘোষাল ২৫ মার্চ রাতের বর্ণনা দিয়ে বলেন, সে রাতে তিনি ছিলেন ৪৫ নম্বর পাটুয়াটুলীতে তার বাবার প্রকাশনা সংস্থা ইস্ট পাকিস্তান পাবলিশার্সের দোতলায়। সেখানে বসেই তিনি শুনতে পান গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ। পরে রাতে সেখান থেকে কয়েক দফা বের হওয়ার চেষ্টা করেও অন্যদের আপত্তির মুখে বের হতে পারেননি। পরদিন ২৬ মার্চ সকালে উঠেই তিনি চলে যান ৫১ নম্বর শাঁখারীবাজারে তাদের ভাড়া বাসায়। সেখানে বড় ভাই রতন ঘোষালের মুখে শোনেন, আগের রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা, রাজারবাগে অসংখ্য বাঙালি পুলিশ হত্যা করেছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের অভিযান চলছে। এ অবস্থায় তাকে বাসায় না থাকার পরামর্শ দেন তার বাবা যামিনী ঘোষাল।
বাবা তাকে বলেন, ‘মনোরঞ্জন, তুমি বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংস্থার সঙ্গে আছো। আওয়ামী লীগের মিটিংয়ে যাও; তোমার বিপদ বেশি। খুঁজে দেখো, কয়েক দিন নিরাপদ কোথাও থাকতে পারো কিনা।’ দুপুরে খেয়ে বাবার কথামতো তিনি বাসা থেকে বের হন। চলে যান আরো কিছুটা গলিপথের ভেতরে ১১ নম্বর গোবিন্দলাল দত্ত লেনে তার বন্ধু কালীদাসের বাসায়। সেখান থেকে কালীদাসের ভাই শান্তিদাসসহ যান মতিঝিলে কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিল ও নিশাত জুট মিলের অফিসে। তখন সেটা পরিচিত ছিল গোলক চেম্বার হিসেবে। তারা এ স্থানটিই সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে বেছে নেন। এখানে চাকরি করত কালীদাস।
সন্ধ্যার আগে সেখানে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই কালীদাসের পরিচিত ভবনের একজন নিরাপত্তারক্ষী জানান, পুরো শহরে কারফিউ জারি হয়েছে। পরের দিন ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলো। তখন তিনি আবারো শাঁখারীবাজারে তার বাসায় যান। বাসায় ঢোকার মুহূর্তেই তাদের প্রতিবেশী কলেজশিক্ষক নলিনী রঞ্জন রায় তাকে জানান, ২৬ মার্চ রাতে তার বড় ভাই রতন ঘোষালকে বাসার দরজার সামনেই পাকিস্তানিরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। বাসায় ঢুকতেই দেখলেন, বাবা-মা-বৌদি বিলাপ করে কাঁদছেন। এ অবস্থার মধ্যেও তার বাবা হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, ‘এখন ভাইয়ের জন্য শোক প্রকাশের সময় নেই। এ টাকা নিয়ে তুমি দ্রুত ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাও। তোমাকেও ওরা মেরে ফেলবে।’ মনোরঞ্জন পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবারো পথে নামলেন।