র্যাবের যৌথ অভিযানে ঢাকা পূর্ব বাসাবো এলাকার বাসা থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি উখিয়া টেকনাফের সাবেক সংসদ আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদির ম্যানেজার জাফর আহমেদকে আটক করেছে। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের উত্তর নেঙ্গুলবিল এলাকার বাসিন্দা মৃত সুলতান আহম্মদের ছেলে জাফর আহম্মদ (৬৭)। তিনি টেকনাফ পৌরসভা ২নং ওয়ার্ড পুরাতন পল্লান পাড়া এলাকার বাসিন্দা।শুক্রবার (১ নভেম্বর) রাতে ঢাকা পূর্ব বাসাবো এলাকায় যৌথ অভিযান চালিয়ে বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়।কক্সবাজার র্যাব ১৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।তিনি বলেন, টেকনাফে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রদের বিরুদ্ধে সকল হামলা ও কুকীর্তির নেতৃত্বে ছিল জাফর আহম্মদ প্রকাশ মাফিয়া জাফর। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরপর টেকনাফের ঝর্নাচত্বর এলাকায় ছাত্র জনতার উপর জাফরের নেতৃত্বে নির্বিচারে গুলি চালায় জাফরসহ তার লালিত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। হামলার সময় তাদের হাতে দুটি শর্টগান ও একটি পিস্তল দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। গত ১৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলার অন্যতম আসামি জাফর আহম্মদ প্রকাশ মাফিয়া জাফর। এই মামলার প্রধান আসামি ইয়াবা গডফাদার আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদি ইতিপূর্বে র্যাবের হাতে আটক হলেও তার বিশ্বস্ত সহযোগী জাফর এতদিন অধরাই ছিল। র্যাব তাকে গ্রেপ্তারের জন্য সব সময় অভিযান অব্যাহত রেখেছে।লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ১ নভেম্বর রাতে গোয়েন্দা নজরদারি মাধ্যমে র্যাব-১৫ এবং র্যাব-৩ ঢাকা পূর্ব বাসাবো এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে জাফর আহমদকে আটক করা হয়। গত ৫ আগস্ট রাতে টেকনাফে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জাফর এবং তার তিন ছেলের নেতৃত্বে টেকনাফের আলো শপিং কমপ্লেক্স, হোটেল নাফ কুইন ও আব্দুল্লাহ ব্রাদার্স ফিলিং স্টেশনে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। উক্ত ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা রুজু করা হয়। তিনটি মামলায় মাদকের গডফাদার জাফর আহম্মদ প্রকাশ মাফিয়া জাফর এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়।র্যাব সূত্রে জানা যায়, টেকনাফের ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা সিন্ডিকেটের ডন মাদক সম্রাট আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদির বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে এলাকায় পরিচিত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহম্মদ প্রকাশ মাফিয়া জাফর। সংসদ সদস্য থাকাকালে আব্দুর রহমান বদি নিজের নির্বাচনি এলাকা টেকনাফকে পরিণত করেছিলেন মাদক, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যার স্বর্গরাজ্যে। আর সেই স্বর্গরাজ্য কার্যক্রমের বিশ্বস্ত সহচর ছিল জাফর। ২০২২ সালে ডিসেম্বর ১২৭৫ জন মাদক কারবারিকে তালিকাভুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে আব্দুর রহমান বদি ও তার ঘনিষ্ঠ সহচর জাফরকে ইয়াবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০১৯ সালে আত্মসমর্পণকারী মাদককারবারীরা পুনরায় জামিনে বের হয়ে জাফরের নেতৃত্বে আবার সঙ্গবদ্ধ হয়েছে এবং ইয়াবা ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে।জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদির অপরাধ জগতের বিশ্বস্ত সহচর আটককৃত জাফর প্রথম জীবনে ছিলেন পান বাজারের শ্রমিক। সেখান থেকে হয়ে উঠেন শ্রমিক নেতা নামধারী দুর্ধর্ষ চাঁদাবাজ। এই চাঁদাবাজির অর্থে সে টেকনাফ সদরের উপজেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। এরপর থেকে তার আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর কৌশলে একটি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হয়ে টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কালের পরিক্রমায় জাফর নানারূপে আবির্ভূত হয়ে আব্দুর রহমান বদির বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে মাদক সাম্রাজ্য সম্প্রসারনপূর্বক অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় জাফর গ্রেফতার হলে কারাগারে আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদির সাথে তার সব সখ্যতা গড়ে ওঠে। এরপর সে রাজনৈতিক মতাদর্শ পরিবর্তন করে আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদির সাথে যুক্ত হয়ে অন্য একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেয় এবং আব্দুর রহমান বদির সহায়তায় চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। এরপর জেলা পরিষদ সদস্য ও ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আবারো উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সরকার পতন হলে ১৯ আগস্ট দুই মাসের মাথায় স্বপদ হতে তাকে অপসারিত করা হয়। উক্ত নির্বাচনে আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদি ও জাফরের বিরুদ্ধে ভোট ক্রয়, ভোট চুরি’সহ ব্যালট পেপার ছিনতাই এর অভিযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আব্দুর রহমান বদি তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাফরকে নিয়ে সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফকে মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছেন।তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তার জাফর আহম্মদ প্রকাশ মাফিয়া জাফরের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র, দুদকের মামলাসহ রয়েছে প্রায় এক ডজন মামলা। কয়েকটি মামলায় সে জামিনে থাকলেও অধিকাংশ মামলাই বিচারাধীন। ২০২১ সালের ২১শে জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা এক মামলায় বিপুল পরিমাণ আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। এছাড়াও নাশকতার মামলায় দায়ের হওয়া নাশকতা মামলা গুলোতে এতদিন সে পলাতক এবং গ্রেপ্তার এড়াতে বিভিন্ন জায়গায় ছদ্মবেশ ধারণ করে আত্মগোপনে ছিল। পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হল টেকনাফ স্থলবন্দর।জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও জানা যায়, আমদানি-রপ্তানি সেবা দানকারী সিএন্ডএফ এজেন্সি গুলো আব্দুর রহমান বদির কথার বাইরে যেতে পারত না। বিশ্বস্ত সহচর জাফরকে উস্তাদ বলে সম্বোধন করতো বদি, যার জিম্মি ছিল বন্দরের প্রতিটি ব্যবসায়ী। আব্দুর রহমান বদি ও জাফরের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন এজেন্সি গুলোর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও আরো জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, বন্দর কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি, প্রতি ট্রাকে চাঁদা উঠানোসহ ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে অর্থ আত্মসাৎ এর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।