প্রশ্ন: আপনি মাত্র বললেন, এটা একটা ভিন্ন জগত। রাষ্ট্র পরিচালনায় এই রকম একটা রাজনৈতিক দায়িত্ব, যেটা আপনি চিন্তা করেননি। ২০০৭ সালে যখন আপনি একটা দল করতে গিয়েছিলেন। এটা তো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই চিন্তা করেছিলেন। সেটা যদি আপনি চালিয়ে যেতেন, তাহলে তো আপনাকে রাজনৈতিক দায়িত্বই পালন করতে হতো?
ড. ইউনূস: সেটার কারণ ছিল, রাজনৈতিক দলতো ছিলো না আমার। আমার বন্ধু-বান্ধব বলতো আপনি একটা দল করেন। এভাবে পেছনে লেগে রইলো। আপনি ছাড়া পারবে না কেউ। আশপাশের লোকজন যা যা বলে আরকি। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েই শেষে বললাম আমি করবো দল। সাংবাদিকরা ধরলো, তখন আমি বললাম হ্যাঁ আমি দল গঠন করবো। তখন বিভিন্ন জায়গায় আমি আসা-যাওয়া করছিলাম।
উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিলাম, চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। প্রত্যেকবার এয়ারপোর্টেই এ কথাগুলো হচ্ছিলো। আর কোথাও না। একসময় ধরলো-তাহলে কী নাম দেবেন? আমি বললাম নাম ঠিক করিনি। করলে আপনাদের জানাবো। তখন একটা নাম দিলাম। সেটা হলো নাগরিক শক্তি।
তারপর বুঝলাম বিষয়টা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তখন সবাইকে বললাম, মতামত নাও। কোনোভাবে এটা থেকে দূরে সরে যাওয়া যায় কিনা চেষ্টা করছিলাম। নামও হলো মতামতও হলো। তারপর দেখলাম এর মধ্যে বেশি ঢুকে যাচ্ছি। তখন আমি বললাম না আমি কোনো রাজনৈতিক দল করছি না। তখন রাজনীতির মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এসব আমার মাথায় ছিলো না। পরিকল্পনা ছিলো না, এটা দীর্ঘমেয়াদী জিনিস।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক দলতো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত?
ড. ইউনূস: আমি তখন রাজনৈতিক দল করতে চাচ্ছিলাম না। ঠেকা দেয়া জন্য এগুলো বলে যাচ্ছিলাম। সবাই ধাক্কা দিচ্ছে আপনাকে করতে হবে। শেষে মনে করলাম এটা বেশ গভীরে চলে যাচ্ছে। তখন পরিষ্কার বলে দিলাম। সবাই হতবাক হয়ে গেলো। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলাম।
প্রশ্ন: আপনি কি বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন?
ড. ইউনূস: বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিনি। এজন্য তারা আরও হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারা বললো আমাদেরকে বললেন না। আমরা এতদিন ঘুরলাম।
প্রশ্ন: তাদের (বন্ধু) মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কথা। তারা কি এখন আনন্দে আছে?
ড. ইউনূস: তারা কাছে আসে না। কোনদিকে নিয়ে যায় আবার!
প্রশ্ন: ওই নাগরিক শক্তির সঙ্গে ছাত্রদের নাগরিক কমিটির চিন্তার বা ভাবনার কোনো সম্পর্ক আছে?
ড. ইউনূস: নাগরিক শব্দটা কমন আছে। তাছাড়া আমার সঙ্গে তাদের কোনো আলোচনা হয়নি। তারা শব্দটা কোথায় পেলো।
প্রশ্ন: নাগরিক শব্দটা যেকোনো মানুষ ব্যবহার করতে পারে।
ড. ইউনূস: নাগরিক শব্দটা যেকোনো মানুষ ব্যবহার করতে পারে। আমার সঙ্গে কোনো পরামর্শ হয়নি।
প্রশ্ন: সম্প্রতি আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন এবং আমরাও লক্ষ করছি যে, সরকারের যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কর্মসূচি ও নির্বাচন। এই দুটোকে পরিপূরক না ভেবে একটা সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এটা কি আপনাকে চিন্তিত করে?
ড. ইউনূস: না, এখনো সাংঘর্ষিক পর্যায়ে যায়নি। একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলাম। প্রক্রিয়া হলো, কতগুলো কমিশন গঠন করেছি। একেকটা বিষয়ের ওপর কমিশন গঠন করেছি। এই রকম ১৫টি কমিশন করেছি। তারমধ্যে ৬টি কমিশন প্রথম ঘোষণা করেছিলাম। ৯০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার কথা ছিলো। তারা নব্বই দিনের মধ্যে শেষ করতে পারেনি। তারা বলেছে ১ সপ্তাহ দেরি হতে পারে। কারণ আয়োজন করতেও সময় লেগেছে।
ঘোষণা করেছি, প্রথমে তাদের বসার জায়গা দিতে পারিনি। কাজেই ঠিক নব্বই দিন সময় তারা পায়নি। ৬টা কমিশন যদি ৭ই জানুয়ারির মধ্যে রিপোর্ট দিয়ে দেয়, তাহলে আমরা পাবো। ওখানে সংস্কার বিষয়ক সব বিষয় দেয়া থাকবে। তাহলে সংস্কারের রূপরেখাটা আমরা পেলাম। ইতিমধ্যে মত বিনিময় হয়েছে। তার মধ্যে কোনোটা টিকেছে আবার কোনোটা টেকেনি।
তারপর কমিশন মনে করেছে এটাই আমাদের সারমর্ম। তখন বৃহত্তর সংলাপের জন্য এগুলো নিয়ে আসবে। সেদিন একটা সংলাপ হয়েও গেলো। যদিও এখনো রিপোর্ট আসেনি। সবাইকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলো কোনটা পছন্দ, কোনটা অপছন্দ। সেদিন একটা কমিশন ঘোষণা করলাম। এই কমিশনের চেয়ারম্যানদের দিয়ে একটা কমিশন, যেটার বাইরে থেকে আমি নিজে চেয়ারম্যান হলাম। সেখানে প্রফেসর আলী রীয়াজকে সহ-সভাপতি করলাম।
প্রশ্ন: আমরা লক্ষ করছি পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যারা নতুন রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন, অর্থাৎ তরুণরা যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে তারা নির্বাচনের জন্য সময় নিতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচন প্রক্রিয়া এগিয়ে আনা দরকার। তবে পাবলিক ডিবেটের মধ্যে এক ধরনের তিক্ততা তৈরি হয়েছে। আপনার নজরে এসেছে?
ড. ইউনূস: খুব ভালো করে নজরে এসেছে।
প্রশ্ন: সেটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার নয়?
ড. ইউনূস: মোটেও না। কারণ ওই যে বললাম, বাইরে একরকম, ভেতরে আরেক রকম। সেই কারণে তারা শেষ পর্যন্ত একমত হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে রাজনৈতিক রক্তাক্ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেটাকে আমাদের পাশের দেশ ভারত এক ধরনের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং নানান কথা বলছে। এটা ঠিক জাতীয়তাবাদী চৈতন্য থেকে নয়, দেশকে ভালোবাসি বলে নয়, তথ্য বিকৃতি হিসেবে নানা জায়গা থেকে মিডিয়া এগুলো সাধ্যমতো বলছে। কিন্তু সেটা হচ্ছে একটা মিডিয়ার লড়াই। বলতে চাচ্ছি বস্তুত ফাংশনাল ডিপ্লোম্যাসিতে আপনার এ ক’দিনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ভারতের সম্পর্কে একটা সুষ্ঠু ওয়ার্কিং রিলেশন তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কি আমরা এগুতে পেরেছি?
ড. ইউনূস: আমরা বরাবরই সেটা চেষ্টা করছি। ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরা। প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ফোনে আলাপ হলো (উনি ফোন করেছিলেন)। উনি অভিযোগ করলেন এখানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। বললাম, যে এটা অতিরঞ্জিত কতগুলো সংবাদ আপনার কাছে যাচ্ছে। কাজেই এটা আপনি বিশ্বাস করবেন না। যদি আপনি প্রকৃত তথ্য জানতে চান আপনার সাংবাদিকদের পাঠান। এখানে আসুক, তারা দেখুক। দেখে রিপোর্ট করুক। আমাদের তথ্যগুলো যদি আস্থায় আনতে না চান তাহলে এটাই প্রকৃত পরিস্থিতি।
পরবর্তীতে অনেক ভারতীয় সাংবাদিক এখানে এসেছিলেন। তারা রিপোর্ট করেছেন। আমরা চেষ্টা করছি যাতে করে অতিরঞ্জন থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু কিছু সংবাদ আছে যেগুলো অতিরঞ্জনের বিষয় না। এগুলো একেবারে গাঁজাখুরি কতগুলো কথা। সে রকম চলছেই। নানারকম আজগুবি সংবাদ দিচ্ছে।
পরবর্তীতে যখন তাদের পররাষ্ট্র সচিব আসলেন তখন বললাম এরকম কেন হচ্ছে? উনি বললেন, এটা আমাদের সরকারের বিষয় না। সরকার এটার মধ্যে জড়িত না। এগুলো মিডিয়ার বিষয়। আমাদের আওতার বাইরে। কাজেই সরকার এটা থেকে দূরে সরলো। কাজেই এটা আমাদের জন্য একটা বড় অ্যাচিভমেন্ট। এতদিন সরকার এটার মধ্যে জড়িত ছিল বলে প্রকাশ করছিল। এখন বলছে আমাদের না। কাজেই এটা হয়ে গেল। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের তথ্যগুলো তাদের কাছে দেয়ার জন্য।
ইন্টারন্যাশনাল করেসপন্ডডেন্টরা যখন আসে তারা করে। এখন মনে হয় ইন্টারন্যাশনাল কভারেজের কারণে অতবেশি জুত করতে পারছে না। এখনো উলটাপাল্টা খবর দিচ্ছে, কিন্তু জুত করতে পারছে না। আগে বলছিল, এটা ইসলামিস্ট অভ্যুত্থান হয়েছে। তালেবানদের হাতে চলে গেছে ইত্যাদি। পত্র-পত্রিকা, ইন্টারন্যাশনাল কাগজপত্রে যখন আসছে ওখানে তারা আর সুবিধা করতে পারছে না ওরকম বলে। কিছু কাগজ দেখালো এখানে, দেখা গেল কেবিনেটের মধ্যে কারা কারা আছে। তাদের যে পরিচিতি দিল কেউ বিশ্বাস করবে না এরা ইসলামিস্ট গোষ্ঠীর। কাজেই এই ধরনের প্রোপাগান্ডা আগের থেকে অনেকটা কমেছে।